কুমির উৎপাদনে চমক দেখাল ভালুকা!!!

ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বিস্তীর্ণ শালবন পরিবেষ্টিত হাতিবেড় গ্রাম। এ গ্রামটিতে গড়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র কুমির প্রজনন খামার রেপটাইলস। এরই মধ্যে কুমির উৎপাদনে এ খামারটি ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। এটি এশিয়া মহাদেশে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুমির উৎপাদন খামার। ফলে পুরোদমে কুমির উৎপাদন ও রফতানি শুরু হলে দেশের অর্থনীতির সম্ভাবনার সিংহ দুয়ার খুলে যাবে।


২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বরের ১৩ একর জমির ওপর গড়ে উঠা খামারে প্রথম মালয়শিয়া থেকে ক্রোকোডাইলস প্রোসাস প্রজাতির ৭৫টি কুমির আমদানি করে ফার্মটির আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু। বর্তমানে এ প্রকল্পে ছোট-বড় মিলিয়ে কুমির আছে ১ হাজার ৭০০টি। চাষ করা এই কুমিরের প্রজাতি মূলত লোনা পানির। তবে লোনা পানির প্রজাতি হলেও এটি আমাদের দেশের আবহাওয়া এবং পানিতে বাস করতে পারে। সুন্দরবনে যে কুমির পাওয়া যায় সেগুলোও একই প্রজাতির। এজন্য ক্রোকোডাইলস প্রোসাস প্রজাতির কুমিরকে বেছে নেয়া হয়েছে।

বিশ্বে লোনা পানির কুমিরের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। সারা বিশ্বে এখন যেসব কুমিরের চামড়া পাওয়া যায় তার তুলনায় এ প্রজাতিটির চামড়া শতকরা মাত্র একভাগ। প্রোসাস প্রজাতির চামড়ায় তৈরি জিনিসপত্রের কদর সবচেয়ে বেশি। শুধু চামড়া নয়, মাংস, হাড়, দাঁত এগুলোর চাহিদা এবং কদরও অনেক বেশি। কুমিরের চামড়া, মাংস, হাড়, দাঁত সবই যেন সোনা। চামড়া, মাংস, হাড়, দাঁত এমনকি ডিম কিছুই ফেলে দেয়ার বস্তু নয়। এ সবকিছুই চড়া মূল্যে বিক্রি হয়। কুমিরের চামড়া থেকে বেল্ট, হাড় দিয়ে পারফিউম, দাঁত দিয়ে মূল্যবান অলঙ্কার ও রক্ত দিয়ে ক্যান্সার রোগ প্রতিষেধক তৈরি হয়। এছাড়াও ফ্রান্স, আমেরিকা, জার্মান, স্পেন, ইতালি, চীন, থাইল্যান্ড ও তাইওয়ানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কুমিরের মাংসের চাহিদা রয়েছে।

জানা গেছে, বিশ্বে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের কুমিরের মাংসের বাজার রয়েছে। বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় রেপটাইলসকে ২০০৪ সালের ৫ মে মাসে কুমির চাষের জন্য অনুমতি দেয়। এরপর আন্তর্জাতিক সংস্থা সিআইটিইএসের অনুমোদন সাপেক্ষে মালয়েশিয়ার সারওয়াত থেকে সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৫টি কুমির আমদানি করে। যে  প্রত্যাশা নিয়ে রেপটাইলস যাত্রা শুরু করে ছিল সেই প্রত্যাশা  আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে।

সাত বছর ধরে একাধারে বিনিয়োগের পর রফতানিযোগ্য ৫০০ কুমির থেকে ২০১০ সালে ৫ থেকে ৭ ফুট লম্বা আকারের ৬৭টি কুমির হিমায়িত করে জার্মানির হাইডলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য রফতানি করা হয়েছে। ৬৭ কুমিরের রফতানি মূল্য ৫০ হাজার ডলার ছিল। সূত্র জানিয়েছে, ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে জার্মান হাইডলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড কুমির রফতানির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। এরপর সরকার কুমির রফতানির চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে ২০১০ সালে ৬৭টি কুমির রফতানি হয়। জার্মানির হাইডলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় কুমিরের শরীরের অংশ বিশেষ থেকে মানব দেহের রোগ প্রতিরোধক মেডিসিন আবিষ্কার কাজে ব্যবহার করছে।

এছাড়া বাকি ৪৩৩টি কুমিরের চামড়া ও মাংস ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রফতানির করা হবে। এর মধ্যে স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালি এ ফার্মের কুমিরের ব্যাপারে প্রচ- আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

২০০৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সবগুলো কুমিরের খাবার বাবদ মাসে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে।

খামারের ব্যবস্থাপক  ডা. আবু সাইম মোহাম্মদ আরিফ বলেন, কুমির একটি সংবেদনশীল প্রাণী। কুমির লালন-পালন করা একটি কঠিন কাজ। কুমিরকে মাছ, মাংসসহ অন্যান্য খাবার দেয়া হয়। বড় কুমিরের ক্ষেত্রে সপ্তাহে ও ছোট কুমিরের ক্ষেত্রে প্রতিদিনই খাবার দিতে হয়। কুমিরের খাদ্য হিসেবে সাধারণত গরু, বয়লার মুরগির মাংস ও বিভিন্ন মাছ দেয়া হয়। যেসব কুমিরের বয়স ৬ মাস থেকে ২ বছর সেগুলোকে মুরগির মাথা কুঁচি করে খাবার হিসেবে দেয়া হয়। আর ছয় মাসের কম বয়সী কুমিরকে দেয়া হয় মাংসের কিমা। এ খামারে স্থায়ীভাবে কর্মরত রয়েছেন ২০ জন শ্রমিক।

বছরে একবার বর্ষাকালে কুমির ডিম দেয়। একসঙ্গে একটি কুমির প্রায় ৩৫ থেকে ৭০টি ডিম দেয়। যে বাসায় ডিম দেয় সেই বাসা থেকে সাবধানে কয়েকজন মিলে  ডিমগুলো সংগ্রহ করতে হয়। ডিম সংগ্রহের সময় কুমির এসে আক্রমণ করল কিনা সেদিকেও তীক্ষè নজর রাখা ছাড়া অন্য উপায় নেই। সংগ্রহ করা ডিমগুলো ইনকিউবেটরে রাখার সময় প্রাথমিকভাবে অবস্থান (বাসায় যে অবস্থায় থাকে) অপরিবর্তিত রাখা বাধ্যতামূলক। কারণ অবস্থান পরিবর্তন হলে ডিম থেকে আর বাচ্চা হয় না। বাসা থেকে ডিম তোলার সময় কালি দিয়ে অ্যাঙ্গেল মার্কিং করে ঠিক সেভাবে ইনকিউবেটরে বসানো হয়। ডিমগুলো বসানোর পর ৩২ থেকে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৮০ থেকে ৯০ দিন রাখলে বাচ্চা ফোটতে শুরু করে। কুমির বেড়ে উঠে পুকুর ও নার্সারিতে। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার পর দীর্ঘ সময়ের জন্য সেগুলোকে রাখা হয় নার্সারি ফার্মে। নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আলো এবং সার্বক্ষণিক দেখভাল করার মাধ্যমে বেড়ে ওঠে কুমিরে বাচ্চাগুলো। বাইরে থেকে শব্দ যাতে সেখানে পৌঁছতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। কারণ বাচ্চা কুমিরগুলো নির্দিষ্ট শব্দ ছাড়া অন্য শব্দ শুনলে ভয় পেতে পারে। অচেনা মানুষের গন্ধ নাকে গেলে বাচ্চা কুমির খাবার খায় না।

রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের চেয়ারম্যান মেজবাহুল হক বলেন, ভালুকার এ খামারটি অবশেষে আলোর মুখ দেখছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিকে কুমির চাষের নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে দেশে। যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তরিক সহযোগিতা।

No comments

Powered by Blogger.